নবীদের কাহিনী আদম আলাইহিস সালাম
লেখক:প্রফেসর
ডঃ
আসাদুল্লাহ
আল-
গালিব
১.
হযরত
আদম
(আলাইহিস
সালাম)
বিশ্ব
ইতিহাসে
প্রথম
মানুষ ও প্রথম নবী হিসাবে আল্লাহ পাক আদম ( আলাইহিস সালাম)-
কে নিজ দু’হাত দ্বারা সরাসরি সৃষ্টি করেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) । মাটির
সকল উপাদানের সার-নির্যাস একত্রিত করে আঠালো ও পোড়ামাটির
ন্যায় শুষ্ক মাটির তৈরী সুন্দরতম অবয়বে রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ
আদমকে সৃষ্টি করেছেন।[1]
অতঃপর আদমের পাঁজর থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন।[2]
আর এ কারণেই স্ত্রী জাতি স্বভাবগত ভাবেই পুরুষ জাতির অনুগামী
ও পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে যুগ যুগ
ধরে একই নিয়মে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কুরআন-এর
বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম দিন থেকেই মানুষ পূর্ণ চেতনা ও জ্ঞান
সম্পন্ন সভ্য মানুষ হিসাবেই যাত্রারম্ভ করেছে এবং আজও সেভাবেই
তা অব্যাহত রয়েছে। অতএব গুহামানব, বন্যমানব, আদিম মানব ইত্যাদি
বলে অসভ্য যুগ থেকে সভ্য যুগে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে বলে কিছু
কিছু ঐতিহাসিক যেসব কথা শুনিয়ে থাকেন, তা অলীক কল্পনা
ব্যতীত কিছুই নয়। সূচনা থেকে এযাবত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষ
কখনোই মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। মানুষ বানর বা উল্লুকের
উদ্বর্তিত রূপ বলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চার্লস ডারউইন
(১৮০৯-১৮৮২) যে ‘বিবর্তনবাদ’ (Theory of Evolution) পেশ করেছেন,
তা বর্তমানে একটি মৃত মতবাদ মাত্র এবং তা প্রায় সকল বিজ্ঞানী
কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সর্ব বিষয়ের
জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর খেলাফত
পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সাথে সাথে সকল সৃষ্ট
বস্ত্তকে করে দেন মানুষের অনুগত (লোকমান ৩১/২০) ও সবকিছুর
উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব (ইসরা ১৭/৭০) । আর সেকারণেই জিন-
ফিরিশতা সবাইকে মানুষের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য
আদমকে সিজদা করার আদেশ দেন। সবাই সে নির্দেশ মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু ইবলীস অহংকার বশে সে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের
মত অভিশপ্ত হয়ে যায় (বাক্বারাহ ২/৩৪) । অথচ সে ছিল বড় আলেম ও
ইবাদতগুযার। সেকারণ জিন জাতির হওয়া সত্ত্বেও সে ফিরিশতাদের
সঙ্গে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিল ও তাদের নেতা হয়েছিল।[3]
কিন্তু আদমের উচ্চ মর্যাদা দেখে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। ফলে
অহংকার বশে আদমকে সিজদা না করায় এবং আল্লাহ ভীতি না
থাকায় সে আল্লাহর গযবে পতিত হয়। এজন্য জনৈক আরবী কবি
বলেন,
ﻟﻮﻛﺎﻥ ﻟﻠﻌﻠﻢ ﺷﺮﻑ ﻣﻦ ﺩﻭﻥ ﺍﻟﺘﻘﻰ
ﻟﻜﺎﻥ ﺃﺷﺮﻑ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺇﺑﻠﻴﺲُ
‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,
তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত’।
শয়তানের সৃষ্টি ছিল মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ :
ইবলীসকে আল্লাহ মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ সৃষ্টি করেন এবং
ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার হায়াত দীর্ঘ করে দেন। মানুষকে আল্লাহর পথ
থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য ও তাকে ধোঁকা দেওয়াই শয়তানের একমাত্র
কাজ। ‘সে মানুষকে বলে কুফরী কর’। কিন্তু যখন সে কুফরী করে, তখন
শয়তান বলে ‘আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহ্কে
ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬) । অন্যদিকে যুগে যুগে নবী-রাসূল ও কিতাব
পাঠিয়ে আল্লাহ মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা অব্যাহত
রাখেন (বাক্বারাহ ২/২১৩) । আদম থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ
(ছাঃ) পর্যন্ত এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন[4]
এবং বর্তমানে সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক
মুসলিম ওলামায়ে কেরাম শেষনবীর ‘ওয়ারিছ’ হিসাবে[5] আল্লাহ
প্রেরিত অহীর বিধান সমূহ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন
করে যাচ্ছেন (মায়েদাহ ৫/৬৭) । পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংস তথা
ক্বিয়ামতের অব্যবহিত কাল পূর্ব পর্যন্ত এই নিয়ম জারি থাকবে।
শেষনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর এমন কোন বস্তি ও ঝুপড়ি
ঘরও থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবেন না।
[6] এতদসত্ত্বেও অবশেষে পৃথিবীতে যখন ‘আল্লাহ’ বলার মত কোন
লোক থাকবে না, অর্থাৎ প্রকৃত তাওহীদের অনুসারী কোন মুমিন বাকী
থাকবে না, তখন আল্লাহর হুকুমে প্রলয় ঘনিয়ে আসবে এবং ক্বিয়ামত
সংঘটিত হবে।[7] মানুষের দেহগুলি সব মৃত্যুর পরে মাটিতে মিশে
যাবে। কিন্তু রূহগুলি স্ব স্ব ভাল বা মন্দ আমল অনুযায়ী ‘ইল্লীন’
অথবা ‘সিজ্জীনে’ অবস্থান করবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৭, ১৮) । যা
ক্বিয়ামতের পরপরই আল্লাহর হুকুমে স্ব স্ব দেহে পুনঃপ্রবেশ করবে
( ফজর ৮৯/২৯ ) এবং চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের জন্য সকল মানুষ সশরীরে
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে নীত হবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৪-৬) ।
মানুষের ঠিকানা হ’ল তিনটি : ১- দারুদ দুনিয়া। অর্থাৎ যেখানে
আমরা এখন বসবাস করছি ২- দারুল বরযখ। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে কবরের
জগত। ৩- দারুল ক্বারার। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন শেষ বিচার শেষে
জান্নাত বা জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা।
অতএব পৃথিবী হ’ল মানুষের জন্য সাময়িক পরীক্ষাগার মাত্র।
জান্নাত থেকে নেমে আসা মানুষ এই পরীক্ষাস্থলে পরীক্ষা শেষে
সুন্দর ফল লাভে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাবে, অথবা ব্যর্থকাম হয়ে
জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর সেখানেই হবে তাদের সর্বশেষ
যাত্রাবিরতি এবং সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা।
আল্লাহ বলেন, ‘মাটি থেকেই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি। ঐ
মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব। অতঃপর ঐ মাটি থেকেই আমরা
তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব’ (ত্বোয়াহা ২০/৫৫) । অতঃপর
বিচার শেষে কাফেরদেরকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে জাহান্নামের দিকে
এবং মুত্তাক্বীদের নেওয়া হবে জান্নাতে (যুমার ৩৯/৬৯-৭৩) ।
এভাবেই সেদিন যালেম তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে এবং মযলূম
তার যথাযথ প্রতিদান পেয়ে ধন্য হবে। সেদিন কারু প্রতি কোনরূপ
অবিচার করা হবে না (বাক্বারাহ ২/২৮১) ।
উল্লেখ্য যে, হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি
সূরায় ৫০টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[8]
এক্ষণে আদম সৃষ্টির ঘটনাবলী কুরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার
আলোকে সার-সংক্ষেপ আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
আদম সৃষ্টির কাহিনী :
আল্লাহ একদা ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে
‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে
তোমাদের বক্তব্য কি? তারা (সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে সৃষ্ট জিন জাতির
তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে) বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি
পৃথিবীতে এমন কাউকে আবাদ করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে
ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার
হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি।
এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য আপত্তির জন্য ছিল না, বরং
জানার জন্য ছিল। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা
জানো না (বাক্বারাহ ২/৩০) । অর্থাৎ আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন
একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন
এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-
সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত
করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।
খলীফা অর্থ :
এখানে ‘খলীফা’ বা প্রতিনিধি বলে জিনদের পরবর্তী প্রতিনিধি
হিসাবে বনু আদমকে বুঝানো হয়েছে, যারা পৃথিবীতে একে অপরের
প্রতিনিধি হবে (ইবনু কাছীর) । অথবা এর দ্বারা আদম ও পরবর্তী
ন্যায়নিষ্ঠ শাসকদের বুঝানো হয়েছে, যারা জনগণের মধ্যে আল্লাহর
আনুগত্য ও ইনছাফপূর্ণ শাসক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর
প্রতিনিধিত্ব করবে। কেননা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও অন্যায়
রক্তপাতকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতিনিধি নয় ( ইবনু জারীর )। তবে
প্রথম ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য, যা ফেরেশতাদের জবাবে প্রতীয়মান হয় যে,
এমন প্রতিনিধি আপনি সৃষ্টি করবেন, যারা পূর্ববর্তী জিন জাতির মত
পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ ও রক্তপাত ঘটাবে। বস্ত্ততঃ ‘জিন জাতির
উপর ক্বিয়াস করেই তারা এরূপ কথা বলে থাকতে পারে’ ( ইবনু
কাছীর )।
অতঃপর আল্লাহ আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। ‘সবকিছুর নাম’
বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে লয় পর্যন্ত ছোট-বড় সকল সৃষ্টবস্ত্তর
ইল্ম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দিয়ে দেওয়া হ’ল।[9] যা দিয়ে
সৃষ্টবস্ত্ত সমূহকে আদম ও বনু আদম নিজেদের অনুগত করতে পারে
এবং তা থেকে ফায়েদা হাছিল করতে পারে। যদিও আল্লাহর অসীম
জ্ঞানরাশির সাথে মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞানের তুলনা
মহাসাগরের অথৈ জলরাশির বুক থেকে পাখির ছোঁ মারা এক ফোঁটা
পানির সমতুল্য মাত্র।[10] বলা চলে যে, আদমকে দেওয়া সেই
যোগ্যতা ও জ্ঞান ভান্ডার যুগে যুগে তাঁর জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী
সন্তানদের মাধ্যমে বিতরিত হচ্ছে ও তার দ্বারা জগত সংসার উপকৃত
হচ্ছে। আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দেওয়ার পর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের
জন্য আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন। কুরআনে
কেবল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখিত হ’লেও সেখানে জিনদের সদস্য
ইবলীসও উপস্থিত ছিল (কাহফ ১৮/৫০) । অর্থাৎ আল্লাহ
চেয়েছিলেন, জিন ও ফেরেশতা উভয় সম্প্রদায়ের উপরে আদম-এর
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হৌক এবং বাস্তবে সেটাই হ’ল। তবে যেহেতু
ফেরেশতাগণ জিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, সেজন্য
কেবল তাদের নাম নেওয়া হয়েছে। আর দুনিয়াতে জিনদের
ইতিপূর্বেকার উৎপাত ও অনাচার সম্বন্ধে ফেরেশতারা আগে থেকেই
অবহিত ছিল, সেকারণ তারা মানুষ সম্বন্ধেও একইরূপ ধারণা পোষণ
করেছিল এবং প্রশ্নের জবাবে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছিল। উল্লেখ্য
যে, ‘আল্লাহ জিন জাতিকে আগেই সৃষ্টি করেন গনগনে আগুন থেকে’
(হিজর ১৫/২৭) । কিন্তু তারা অবাধ্যতার চূড়ান্ত করে।
আদমকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করার পর আল্লাহ
ফেরেশতাদেরকে ঐসব বস্ত্তর নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সঙ্গত
কারণেই তারা তা বলতে পারল না। তখন আল্লাহ আদমকে নির্দেশ
দিলেন এবং তিনি সবকিছুর নাম বলে দিলেন। ফলে ফেরেশতারা
অকপটে তাদের পরাজয় মেনে নিল এবং আল্লাহর মহত্ত্ব ও
পবিত্রতা ঘোষণা করে বলল, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যতটুকু
শিখিয়েছেন, তার বাইরে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি
সর্বজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিময়’ (বাক্বারাহ ২/৩২) । অতঃপর আল্লাহ তাদের
সবাইকে আদমের সম্মুখে সম্মানের সিজদা করতে বললেন। সবাই
সিজদা করল, ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল ও অহংকারে স্ফীত
হয়ে প্রত্যাখ্যান করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল
(বাক্বারাহ ২/৩৪) । ইবলীস ঐ সময় নিজের পক্ষে যুক্তি পেশ করে
বলল, ‘আমি ওর চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দ্বারা
সৃষ্টি করেছেন আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে’। আল্লাহ বললেন,
তুই বের হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত, তোর উপরে আমার অভিশাপ রইল
পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬-৭৮; আ‘রাফ ৭/১২) ।
সিজদার ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য :
আদমকে সৃষ্টি করার আগেই আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে আদমের প্রতি
সিজদা করার কথা বলে দিয়েছিলেন (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত
৪১/১১) । তাছাড়া কুরআনের বর্ণনা সমূহ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে,
আদমকে সিজদা করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ ব্যক্তি আদম হিসাবে
ছিল না, বরং ভবিষ্যৎ মানব জাতির প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে তাঁর
প্রতি সম্মান জানানোর জন্য জিন ও ফিরিশতাদের সিজদা করতে
বলা হয়েছিল। এই সিজদা কখনোই আদমের প্রতি ইবাদত পর্যায়ের
ছিল না। বরং তা ছিল মানবজাতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও
তাদেরকে সকল কাজে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দানের প্রতীকী ও
সম্মান সূচক সিজদা মাত্র।
ওদিকে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’লেও ইবলীস কিন্তু আল্লাহকে
সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে অস্বীকার করেনি। বরং আল্লাহ
যখন তাকে ‘অভিসম্পাৎ’ করে জান্নাত থেকে চিরদিনের মত
বিতাড়িত করলেন, তখন সে আল্লাহ্কে ‘রব’ হিসাবেই সম্বোধন করে
প্রার্থনা করল, ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺏِّ ﻓَﺄَﻧﻈِﺮْﻧِﻲ ﺇِﻟَﻰ ﻳَﻮْﻡِ ﻳُﺒْﻌَﺜُﻮﻥَ - ‘হে আমার প্রভু! আমাকে
আপনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিন’ (হিজর ১৫/৩৬, ছোয়াদ
৩৮/৭৯) । আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। অতঃপর সে বলল,
‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন,
আমিও তেমনি তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানারূপ সৌন্দর্যে প্রলুব্ধ
করব এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দেব। তবে যারা আপনার একনিষ্ঠ
বান্দা, তাদের ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৩৪-৪০; ছোয়াদ ৩৮/৭৯-৮৩) ।
আল্লাহ তাকে বললেন, তুমি নেমে যাও এবং এখান থেকে বেরিয়ে
যাও। তুমি নীচুতমদের অন্তর্ভুক্ত। এখানে তোমার অহংকার করার
অধিকার নেই’ (আ‘রাফ ৭/১৩) । উল্লেখ্য যে, ইবলীস জান্নাত থেকে
বহিষ্কৃত হ’লেও মানুষের রগ-রেশায় ঢুকে ধোঁকা দেওয়ার ও বিভ্রান্ত
করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন।[11] আর এটা ছিল মানুষের
পরীক্ষার জন্য। শয়তানের ধোঁকার বিরুদ্ধে জিততে পারলেই মানুষ
তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে এবং আখেরাতে
জান্নাত লাভে ধন্য হবে। নইলে ইহকাল ও পরকালে ব্যর্থকাম হবে।
মানুষের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদা করা ও ইবলীসের সিজদা না
করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে এ বিষয়ে যে, মানুষ যেন প্রতি পদে পদে
শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের
মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখে।
18
আদমের পাঁচটি শ্রেষ্ঠত্ব :
(১) আল্লাহ তাকে নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) । (২)
আল্লাহ নিজে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২) । (৩)
আল্লাহ তাকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিয়েছেন (বাক্বারাহ
২/৩১) । (৪) তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ
দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩৪) । (৫) আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট।
বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট (সাজদাহ ৩২/৭-৯) ।
ইবলীসের অভিশপ্ত হওয়ার কারণ ছিল তার ক্বিয়াস। সে আল্লাহর
আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করে বলেছিল, ‘আমি আদমের চাইতে
উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে
সৃষ্টি করেছেন মাটি দয়ে’ (হিজর ২৯) । মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন, ﺍﻭﻝ
ﻣﻦ ﻗﺎﺱ ﺍﺑﻠﻴﺲ ‘প্রথম ক্বিয়াস করেছিল ইবলীস’। হাসান বছরীও অনুরূপ
বলেছেন।[12]
নারী জাতি পুরুষেরই অংশ এবং তার অনুগত :
সিজদা অনুষ্ঠানের পর আল্লাহ আদমের জুড়ি হিসাবে তার অবয়ব
হ’তে একাংশ নিয়ে অর্থাৎ তার পাঁজর হ’তে তার স্ত্রী হাওয়াকে
সৃষ্টি করলেন[13] মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’
এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল
‘হাওয়া’ (কুরতুবী) । অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বললেন,
‘তোমরা দু’জন জান্নাতে বসবাস কর ও সেখান থেকে যা খুশী খেয়ে
বেড়াও। তবে সাবধান! এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা
সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৫) । এতে
বুঝা যায় যে, ফেরেশতাগণের সিজদা কেবল আদমের জন্য ছিল,
হাওয়ার জন্য নয়। দ্বিতীয়তঃ সিজদা অনুষ্ঠানের পরে আদমের অবয়ব
থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, পূর্বে নয়। তিনি পৃথক কোন সৃষ্টি
ছিলেন না। এতে পুরুষের প্রতি নারীর অনুগামী হওয়া প্রমাণিত হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪) ।
অতঃপর বহিষ্কৃত ইবলীস তার প্রথম টার্গেট হিসাবে আদম ও হাওয়ার
বিরুদ্ধে প্রতারণার জাল নিক্ষেপ করল। সেমতে সে প্রথমে তাদের খুব
আপনজন বনে গেল এবং নানা কথায় তাদের ভুলাতে লাগল। এক
পর্যায়ে সে বলল, ‘আল্লাহ যে তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে
নিষেধ করেছেন, তার কারণ হ’ল এই যে, তোমরা তাহ’লে ফেরেশতা
হয়ে যাবে কিংবা তোমরা এখানে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে’
(আ‘রাফ ৭/২০) । সে অতঃপর কসম খেয়ে বলল যে, আমি অবশ্যই
তোমাদের হিতাকাংখী’ (ঐ, ২১) । ‘এভাবেই সে আদম ও হাওয়াকে
সম্মত করে ফেলল এবং তার প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে তারা
উক্ত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করল। ফলে সাথে সাথে তাদের
গুপ্তাঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা তড়িঘড়ি গাছের পাতা সমূহ
দিয়ে তা ঢাকতে লাগল। আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি
তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান
তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (ঐ, ২২) তখন তারা অনুতপ্ত হ’য়ে বলল, ﻗَﺎﻻَ
ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻇَﻠَﻤْﻨَﺎ ﺃَﻧﻔُﺴَﻨَﺎ ﻭَﺇِﻥ ﻟَّﻢْ ﺗَﻐْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﻭَﺗَﺮْﺣَﻤْﻨَﺎ ﻟَﻨَﻜُﻮﻧَﻦَّ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺨَﺎﺳِﺮِﻳﻦَ - ‘হে আমাদের
পালনকর্তা! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যদি আপনি
আমাদের ক্ষমা না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের
অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (২৩) । ‘আল্লাহ তখন বললেন, তোমরা (জান্নাত
থেকে) নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের অবস্থান
হবে পৃথিবীতে এবং সেখানেই তোমরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত
সম্পদরাজি ভোগ করবে’ (২৪) । তিনি আরও বললেন যে, ‘তোমরা
পৃথিবীতেই জীবনযাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান
থেকেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/২০-২৫) ।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইবলীসের কথায়
সর্বপ্রথম হাওয়া প্রতারিত হন। অতঃপর তার মাধ্যমে আদম প্রতারিত
হন বলে যে কথা চালু আছে কুরআনে এর কোন সমর্থন নেই। ছহীহ
হাদীছেও স্পষ্ট কিছু নেই। এ বিষয়ে তাফসীরে ইবনু জারীরে ইবনু
আববাস (রাঃ) থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ।[14] দ্বিতীয়তঃ
জান্নাত থেকে অবতরণের নির্দেশ তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ
ছিলনা। কেননা এটা ছিল তওবা কবুলের পরের ঘটনা। অতএব এটা ছিল
হয়তবা তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দানের জন্য। বরং সঠিক কথা এই যে,
এটা ছিল আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ।
কেননা জান্নাত হ’ল কর্মফল লাভের স্থান, কর্মের স্থান নয়।
তাছাড়া জান্নাতে মানুষের বংশ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। এজন্য দুনিয়ায়
নামিয়ে দেওয়া যরূরী ছিল।
প্রথম বার আদেশ দানের পরে পুনরায় স্নেহ ও অনুগ্রহ মিশ্রিত আদেশ
দিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই নেমে যাও’। অতঃপর পৃথিবীতে
আল্লাহর খলীফা হওয়ার (বাক্বারাহ ২/৩০; ফাত্বির ৩৫/৩৯) মহান
মর্যাদা প্রদান করে বললেন, ‘তোমাদের নিকটে আমার পক্ষ থেকে
হেদায়াত অবতীর্ণ হবে। যারা তার অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন
ভয় বা চিন্তার কারণ থাকবে না। কিন্তু যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে
ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং
সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ
২/৩৮-৩৯) ।
উল্লেখ্য যে, নবীগণ ছিলেন নিষ্পাপ এবং হযরত আদম (আঃ) ছিলেন
নিঃসন্দেহে নিষ্পাপ। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল করেননি। বরং
শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত হয়ে তিনি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ
বৃক্ষের নিকটবর্তী হওয়ার নিষেধাজ্ঞার কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন।
যেমন অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ﻓَﻨَﺴِﻲَ ﻭَﻟَﻢْ ﻧَﺠِﺪْ ﻟَﻪُ ﻋَﺰْﻣًﺎ - ‘অতঃপর
আদম ভুলে গেল এবং আমি তার মধ্যে (সংকল্পের) দৃঢ়তা পাইনি’
(ত্বোয়াহা ২০/১১৫) । তাছাড়া উক্ত ঘটনার সময় তিনি নবী হননি বরং
পদস্খলনের ঘটনার পরে আল্লাহ তাকে নবী মনোনীত করে দুনিয়ায়
পাঠান ও হেদায়াত প্রদান করেন’ (আ‘রাফ ৭/১২২) ।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইবলীসের ক্ষেত্রে আল্লাহ বললেন,
ﻗَﺎﻝَ ﻓَﺎﺧْﺮُﺝْ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﻓَﺈِﻧَّﻚَ ﺭَﺟِﻴﻢٌ - ‘তুমি জান্নাত থেকে বেরিয়ে যাও। নিশ্চয়ই
তুমি অভিশপ্ত’ (হিজর ১৫/৩৪; আ‘রাফ ৭/১৮) । অন্যদিকে আদম ও
হাওয়ার ক্ষেত্রে বললেন, ﻗُﻠْﻨَﺎ ﺍﻫْﺒِﻄُﻮﺍْ ﻣِﻨْﻬَﺎ - ‘ তোমরা নেমে যাও’
(বাক্বারাহ ২/৩৬, ৩৮; আ‘রাফ ৭/২৪) । এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে,
ইবলীস কখনোই আর জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু বনু
আদমের ঈমানদারগণ পুনরায় ফিরে আসতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
নগ্নতা শয়তানের প্রথম কাজ :
মানুষের উপরে শয়তানের প্রথম হামলা ছিল তার দেহ থেকে কাপড়
খসিয়ে তাকে উলঙ্গ করে দেওয়া। আজও পৃথিবীতে শয়তানের পদাংক
অনুসারী ও ইবলীসের শিখন্ডীদের প্রথম কাজ হ’ল তথাকথিত
ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার নামে নারীকে উলঙ্গ করে ঘরের বাইরে
আনা ও তার সৌন্দর্য উপভোগ করা। অথচ পৃথিবীর বিগত সভ্যতাগুলি
ধ্বংস হয়েছে মূলতঃ নারী ও মদের সহজলভ্যতার কারণেই। অতএব
সভ্য-ভদ্র ও আল্লাহভীরু বান্দাদের নিকটে ঈমানের পর সর্বপ্রথম
ফরয হ’ল স্ব স্ব লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও ইযযত-আবরূর হেফাযত
করা। অন্যান্য ফরয সবই এর পরে। নারীর পর্দা কেবল পোষাকে হবে
না, বরং তা হবে তার ভিতরে, তার কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে ও
চাল-চলনে সর্ব বিষয়ে। পরনারীর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও মিষ্ট
কণ্ঠস্বর পরপুরুষের হৃদয়ে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে। অতএব
লজ্জাশীলতাই মুমিন নর-নারীর অঙ্গভূষণ ও পারস্পরিক নিরাপত্তার
গ্যারান্টি। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে একে অপরের থেকে স্ব স্ব
দৃষ্টিকে অবনত রাখবে (নূর ২৪/৩০-৩১) এবং পরস্পরে সার্বিক পর্দা
বজায় রেখে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটুকু স্বাভাবিকভাবে
সংক্ষেপে বলবে। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও
পর্দা বজায় রেখে স্ব স্ব কর্মস্থলে ও কর্মপরিধির মধ্যে
স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং সংসার ও সমাজের কল্যাণে সাধ্যমত
অবদান রাখবে। নেগেটিভ ও পজেটিভ পাশাপাশি বিদ্যুৎবাহী দু’টি
ক্যাবলের মাঝে প্লাষ্টিকের আবরণ যেমন পর্দার কাজ করে এবং
অপরিহার্য এক্সিডেন্ট ও অগ্নিকান্ড থেকে রক্ষা করে, অনুরূপভাবে
পরনারী ও পরপুরুষের মধ্যকার পর্দা উভয়ের মাঝে ঘটিতব্য যেকোন
অনাকাংখিত বিষয় থেকে পরস্পরকে হেফাযত করে। অতএব শয়তানের
প্ররোচনায় জান্নাতের পবিত্র পরিবেশে আদি পিতা-মাতার জীবনে
ঘটিত উক্ত অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা থেকে দুনিয়ার এই পঙ্কিল পরিবেশে
বসবাসরত মানব জাতিকে আরও বেশী সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত।
কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে সেদিকেই হুঁশিয়ার করেছে।
মানব সৃষ্টির রহস্য :
আল্লাহ বলেন, ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻟِﻠْﻤَﻼَﺋِﻜَﺔِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺧَﺎﻟِﻖٌ ﺑَﺸَﺮًﺍ ﻣِّﻦ ﺻَﻠْﺼَﺎﻝٍ ﻣِّﻦْ ﺣَﻤَﺈٍ ﻣَّﺴْﻨُﻮْﻥٍ،
ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺳَﻮَّﻳْﺘُﻪُ ﻭَﻧَﻔَﺨْﺖُ ﻓِﻴْﻪِ ﻣِﻦ ﺭُّﻭﺣِﻲْ ﻓَﻘَﻌُﻮْﺍ ﻟَﻪُ ﺳَﺎﺟِﺪِﻳْﻦَ - ‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা,
যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার
শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব
পূর্ণভাবে তৈরী করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন
তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে’ (হিজর ১৫/২৮-২৯) । অন্যত্র
তিনি বলেন, ﻫُﻮَ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻳُﺼَﻮِّﺭُﻛُﻢْ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺣَﺎﻡِ ﻛَﻴْﻒَ ﻳَﺸَﺂﺀُ ﻵ ﺇِﻟَﻪَ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻌَﺰِﻳﺰُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴﻢُ-
( ﺁﻝ ﻋﻤﺮﺍﻥ ৬)- ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে
আকার-আকৃতি দান করেছেন যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ব্যতীত
কোন উপাস্য নেই। তিনি মহা পরাক্রান্ত ও মহা বিজ্ঞানী’ (আলে
ইমরান ৩/৬) । তিনি আরও বলেন, ﻳَﺨْﻠُﻘُﻜُﻢْ ﻓِﻲْ ﺑُﻄُﻮْﻥِ ﺃُﻣَّﻬَﺎﺗِﻜُﻢْ ﺧَﻠْﻘًﺎ ﻣِّﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﺧَﻠْﻖٍ
ﻓِﻲ ﻇُﻠُﻤَﺎﺕٍ ﺛَﻼَﺙٍ- ( ﺯﻣﺮ ৬)- ‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে
সৃষ্টি করেন একের পর এক স্তরে তিনটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণের
মধ্যে’ (যুমার ৩৯/৬) । তিনটি আবরণ হ’ল- পেট, রেহেম বা জরায়ু এবং
জরায়ুর ফুল বা গর্ভাধার।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে আদম সৃষ্টির তিনটি পর্যায় বর্ণনা করা
হয়েছে। প্রথমে মাটি দ্বারা অবয়ব নির্মাণ, অতঃপর তার আকার-
আকৃতি গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহে শক্তির আনুপতিক হার নির্ধারণ
ও পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং সবশেষে তাতে রূহ
সঞ্চার করে আদমকে অস্তিত্ব দান। অতঃপর আদমের অবয়ব (পাঁজর)
থেকে কিছু অংশ নিয়ে তার জোড়া বা স্ত্রী সৃষ্টি করা। সৃষ্টির সূচনা
পর্বের এই কাজগুলি আল্লাহ সরাসরি নিজ হাতে করেছেন (ছোয়াদ
৩৮/৭৫) । অতঃপর এই পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করে
প্রথম যে যমজ সন্তান জন্ম দেয়, তারাই হ’ল মানুষের মাধ্যমে সৃষ্ট
পৃথিবীর প্রথম মানব যুগল। তারপর থেকে এযাবত স্বামী-স্ত্রীর
মিলনে মানুষের বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদরাজি, জীবজন্তু ও প্রাণীকুলের সৃষ্টি হয়েছে
মাটি থেকে। আর মাটি সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে। পানিই হ’ল সকল
জীবন্ত বস্ত্তর মূল (ফুরক্বান ২৫/৫৪) ।
মৃত্তিকাজাত সকল প্রাণীর জীবনের প্রথম ও মূল একক (Unit) হচ্ছে
‘প্রোটোপ্লাজম’ (Protoplasm)। যাকে বলা হয় ‘আদি প্রাণসত্তা’। এ
থেকেই সকল প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী
একে Bomb shell বলে অভিহিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাটির
সকল প্রকারের রাসায়নিক উপাদান। মানুষের জীবন বীজে প্রচুর
পরিমাণে চারটি উপাদান পাওয়া যায়। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন,
কার্বন ও হাইড্রোজেন। আর আটটি পাওয়া যায় সাধারণভাবে
সমপরিমাণে। সেগুলি হ’ল- ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম,
ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, সালফার ও আয়রণ। আরও আটটি
পদার্থ পাওয়া যায় স্বল্প পরিমাণে। তাহ’ল: সিলিকন, মোলিবডেনাম,
ফ্লুরাইন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার ও যিংক। কিন্তু
এই সব উপাদান সংমিশ্রিত করে জীবনের কণা তথা ‘প্রোটোপ্লাজম’
তৈরী করা সম্ভব নয়। জনৈক বিজ্ঞানী দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এসব মৌল
উপাদান সংমিশ্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন
এবং তাতে কোন জীবনের ‘কণা’ পরিলক্ষিত হয়নি। এই সংমিশ্রণ ও
তাতে জীবন সঞ্চার আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান
এক্ষেত্রে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে সরাসরি আদমকে অতঃপর আদম থেকে
তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ আদম
সন্তানদের মাধ্যমে বনু আদমের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন।
এখানেও রয়েছে সাতটি স্তর। যেমন: মৃত্তিকার সারাংশ তথা
প্রোটোপ্লাজম, বীর্য বা শুক্রকীট, জমাট রক্ত, মাংসপিন্ড,
অস্থিমজ্জা, অস্থি পরিবেষ্টনকারী মাংস এবং সবশেষে রূহ সঞ্চারণ
(মুমিনূন ২৩/১২-১৪; মুমিন ৪০/৬৭; ফুরক্বান ২৫/৪৪; তারেক্ব
৮৬/৫-৭) । স্বামীর শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে রক্ষিত ডিম্বকোষে
প্রবেশ করার পর উভয়ের সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে
(দাহর ৭৬/২) । উল্লেখ্য যে, পুরুষের একবার নির্গত লম্ফমান বীর্যে
লক্ষ-কোটি শুক্রাণু থাকে। আল্লাহর হুকুমে তন্মধ্যকার একটি মাত্র
শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবেশ করে। এই শুক্রকীট পুরুষ ক্রোমোজম Y
অথবা স্ত্রী ক্রোমোজম X হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেটি স্ত্রীর
ডিম্বের X ক্রোমোজমের সাথে মিলিত হয়, সেভাবেই পুত্র বা কন্যা
সন্তান জন্ম গ্রহণ করে আল্লাহর হুকুমে।
মাতৃগর্ভের তিন তিনটি গাঢ় অন্ধকার পর্দার অন্তরালে এইভাবে
দীর্ঘ নয় মাস ধরে বেড়ে ওঠা প্রথমত: একটি পূর্ণ জীবন সত্তার সৃষ্টি,
অতঃপর একটি জীবন্ত প্রাণবন্ত ও প্রতিভাবান শিশু হিসাবে
দুনিয়াতে ভূমিষ্ট হওয়া কতই না বিষ্ময়কর ব্যাপার। কোন মানুষের
পক্ষে এই অনন্য-অকল্পনীয় সৃষ্টিকর্ম আদৌ সম্ভব কী? মাতৃগর্ভের ঐ
অন্ধকার গৃহে মানবশিশু সৃষ্টির সেই মহান কারিগর কে? কে সেই মহান
আর্কিটেক্ট, যিনি ঐ গোপন কুঠরীতে পিতার ২৩টি ক্রোমোজম ও
মাতার ২৩টি ক্রোমোজম একত্রিত করে সংমিশ্রিত বীর্য প্রস্ত্তত
করেন? কে সেই মহান শিল্পী, যিনি রক্তপিন্ড আকারের জীবন
টুকরাটিকে মাতৃগর্ভে পুষ্ট করেন? অতঃপর ১২০ দিন পরে তাতে রূহ
সঞ্চার করে তাকে জীবন্ত মানব শিশুতে পরিণত করেন এবং পূর্ণ-
পরিণত হওয়ার পরে সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেন ( আবাসা
৮০/১৮-২০ )। বাপ-মায়ের স্বপ্নের ফসল হিসাবে নয়নের পুত্তলি
হিসাবে? মায়ের গর্ভে মানুষ তৈরীর সেই বিষ্ময়কর যন্ত্রের দক্ষ
কারিগর ও সেই মহান শিল্পী আর কেউ নন, তিনি আল্লাহ!
সুবহানাল্লাহি ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযীম!!
পুরুষ ও নারীর সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম লাভের তথ্য কুরআনই
সর্বপ্রথম উপস্থাপন করেছে ( দাহর ৭৬/২ )। আধুনিক বিজ্ঞান এ তথ্য
জনতে পেরেছে মাত্র গত শতাব্দীতে ১৮৭৫ সালে ও ১৯১২ সালে।
তার পূর্বে এরিষ্টটল সহ সকল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল যে, পুরুষের
বীর্যের কোন কার্যকারিতা নেই। রাসূলের হাদীছ বিজ্ঞানীদের এই
মতকে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেছে।[15] কেননা সেখানে স্পষ্টভাবে
বলা হয়েছে সন্তান প্রজননে পুরুষ ও নারী উভয়ের বীর্য সমানভাবে
কার্যকর।
উল্লেখ্য যে, মাতৃগর্ভে বীর্য প্রথম ৬ দিন কেবল বুদ্বুদ আকারে
থাকে। তারপর জরায়ুতে সম্পর্কিত হয়। তিন মাসের আগে ছেলে বা
মেয়ে সন্তান চিহ্নিত হয় না। চার মাস পর রূহ সঞ্চারিত হয়ে বাচ্চা
নড়েচড়ে ওঠে ও আঙ্গুল চুষতে থাকে। যাতে ভূমিষ্ট হওয়ার পরে
মায়ের স্তন চুষতে অসুবিধা না হয়। এ সময় তার কপালে চারটি বস্ত্ত
লিখে দেওয়া হয়। তার আজাল (হায়াত), আমল, রিযিক এবং সে
ভাগ্যবান না দুর্ভাগা।[16]
এভাবেই জগত সংসারে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা এগিয়ে চলেছে। এ
নিয়মের ব্যতিক্রম নেই কেবল আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। একারণেই
আল্লাহ অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মানুষ কি দেখে না
যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে
গেল প্রকাশ্যে বিতন্ডাকারী’। ‘সে আমাদের সম্পর্কে নানারূপ
দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়, আর
বলে যে, কে জীবিত করবে এসব হাড়গোড় সমূহকে, যখন সেগুলো পচে
গলে যাবে? (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৮) ।
জান্নাত থেকে পতিত হবার পর :
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে ইমাম
আহমাদ, নাসাঈ ও হাকেম (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, ﺃﻟﺴﺖ ﺑﺮﺑﻜﻢ ‘আমি
কি তোমাদের প্রভু নই? বনু আদমের কাছ থেকে এই বহুল প্রসিদ্ধ
‘আহদে আলাস্ত্ত’ বা প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতিটি তখনই নেওয়া হয়,
যখন আদম (আঃ)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়।
আর এ প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল না‘মান ( ﻭﺍﺩﻯ ﻧَﻌْﻤَﺎﻥَ ) নামক
উপত্যকায়, যা পরবর্তীকালে ‘আরাফাত’-এর ময়দান নামে পরিচিত
হয়েছে।[17] এর দ্বারা একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, জান্নাত ও
জাহান্নামের অবস্থান পৃথিবীর বাইরে অন্যত্র এবং তা সৃষ্ট অবস্থায়
তখনও ছিল এখনও আছে। আধুনিক বিজ্ঞান এ পৃথিবী ও সৌরলোকের
বাইরে দূরে বহুদূরে অগণিত সৌরলোকের সন্ধান দিয়ে কুরআন ও
হাদীছের তথ্যকেই সপ্রমাণ করে দিচ্ছে।
আদমের অবতরণ স্থল :
আদম ও হাওয়াকে আসমানে অবস্থিত জান্নাত থেকে নামিয়ে
দুনিয়ায় কোথায় রাখা হয়েছিল, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন বলা
হয়েছে আদমকে সরনদীপে (শ্রীলংকা) ও হাওয়াকে জেদ্দায় (সঊদী
আরব) এবং ইবলীসকে বছরায় (ইরাক) ও ইবলাসের জান্নাতে ঢোকার
কথিত বাহন সাপকে ইস্ফাহানে (ইরান) নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কেউ বলেছেন, আদমকে মক্কার ছাফা পাহাড়ে এবং হাওয়াকে
মারওয়া পাহাড়ে নামানো হয়েছিল। এছাড়া আরও বক্তব্য এসেছে।
তবে যেহেতু কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি,
সেকারণ এ বিষয়ে আমাদের চুপ থাকাই শ্রেয়।
‘আহ্দে আলাস্ত্ত-র বিবরণ :
মুসলিম ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, কিছু লোক হযরত ওমর ফারূক
(রাঃ)-এর নিকটে সূরা আ‘রাফ ১৭২ আয়াতের মর্ম জানতে চাইলে
তিনি বলেন,
ডঃ
আসাদুল্লাহ
আল-
গালিব
১.
হযরত
আদম
(আলাইহিস
সালাম)
বিশ্ব
ইতিহাসে
প্রথম
মানুষ ও প্রথম নবী হিসাবে আল্লাহ পাক আদম ( আলাইহিস সালাম)-
কে নিজ দু’হাত দ্বারা সরাসরি সৃষ্টি করেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) । মাটির
সকল উপাদানের সার-নির্যাস একত্রিত করে আঠালো ও পোড়ামাটির
ন্যায় শুষ্ক মাটির তৈরী সুন্দরতম অবয়বে রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ
আদমকে সৃষ্টি করেছেন।[1]
অতঃপর আদমের পাঁজর থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন।[2]
আর এ কারণেই স্ত্রী জাতি স্বভাবগত ভাবেই পুরুষ জাতির অনুগামী
ও পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে যুগ যুগ
ধরে একই নিয়মে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কুরআন-এর
বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম দিন থেকেই মানুষ পূর্ণ চেতনা ও জ্ঞান
সম্পন্ন সভ্য মানুষ হিসাবেই যাত্রারম্ভ করেছে এবং আজও সেভাবেই
তা অব্যাহত রয়েছে। অতএব গুহামানব, বন্যমানব, আদিম মানব ইত্যাদি
বলে অসভ্য যুগ থেকে সভ্য যুগে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে বলে কিছু
কিছু ঐতিহাসিক যেসব কথা শুনিয়ে থাকেন, তা অলীক কল্পনা
ব্যতীত কিছুই নয়। সূচনা থেকে এযাবত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষ
কখনোই মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। মানুষ বানর বা উল্লুকের
উদ্বর্তিত রূপ বলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চার্লস ডারউইন
(১৮০৯-১৮৮২) যে ‘বিবর্তনবাদ’ (Theory of Evolution) পেশ করেছেন,
তা বর্তমানে একটি মৃত মতবাদ মাত্র এবং তা প্রায় সকল বিজ্ঞানী
কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সর্ব বিষয়ের
জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর খেলাফত
পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সাথে সাথে সকল সৃষ্ট
বস্ত্তকে করে দেন মানুষের অনুগত (লোকমান ৩১/২০) ও সবকিছুর
উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব (ইসরা ১৭/৭০) । আর সেকারণেই জিন-
ফিরিশতা সবাইকে মানুষের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য
আদমকে সিজদা করার আদেশ দেন। সবাই সে নির্দেশ মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু ইবলীস অহংকার বশে সে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের
মত অভিশপ্ত হয়ে যায় (বাক্বারাহ ২/৩৪) । অথচ সে ছিল বড় আলেম ও
ইবাদতগুযার। সেকারণ জিন জাতির হওয়া সত্ত্বেও সে ফিরিশতাদের
সঙ্গে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিল ও তাদের নেতা হয়েছিল।[3]
কিন্তু আদমের উচ্চ মর্যাদা দেখে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। ফলে
অহংকার বশে আদমকে সিজদা না করায় এবং আল্লাহ ভীতি না
থাকায় সে আল্লাহর গযবে পতিত হয়। এজন্য জনৈক আরবী কবি
বলেন,
ﻟﻮﻛﺎﻥ ﻟﻠﻌﻠﻢ ﺷﺮﻑ ﻣﻦ ﺩﻭﻥ ﺍﻟﺘﻘﻰ
ﻟﻜﺎﻥ ﺃﺷﺮﻑ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻠﻪ ﺇﺑﻠﻴﺲُ
‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,
তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত’।
শয়তানের সৃষ্টি ছিল মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ :
ইবলীসকে আল্লাহ মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ সৃষ্টি করেন এবং
ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার হায়াত দীর্ঘ করে দেন। মানুষকে আল্লাহর পথ
থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য ও তাকে ধোঁকা দেওয়াই শয়তানের একমাত্র
কাজ। ‘সে মানুষকে বলে কুফরী কর’। কিন্তু যখন সে কুফরী করে, তখন
শয়তান বলে ‘আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহ্কে
ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬) । অন্যদিকে যুগে যুগে নবী-রাসূল ও কিতাব
পাঠিয়ে আল্লাহ মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা অব্যাহত
রাখেন (বাক্বারাহ ২/২১৩) । আদম থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ
(ছাঃ) পর্যন্ত এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন[4]
এবং বর্তমানে সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক
মুসলিম ওলামায়ে কেরাম শেষনবীর ‘ওয়ারিছ’ হিসাবে[5] আল্লাহ
প্রেরিত অহীর বিধান সমূহ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন
করে যাচ্ছেন (মায়েদাহ ৫/৬৭) । পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংস তথা
ক্বিয়ামতের অব্যবহিত কাল পূর্ব পর্যন্ত এই নিয়ম জারি থাকবে।
শেষনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর এমন কোন বস্তি ও ঝুপড়ি
ঘরও থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবেন না।
[6] এতদসত্ত্বেও অবশেষে পৃথিবীতে যখন ‘আল্লাহ’ বলার মত কোন
লোক থাকবে না, অর্থাৎ প্রকৃত তাওহীদের অনুসারী কোন মুমিন বাকী
থাকবে না, তখন আল্লাহর হুকুমে প্রলয় ঘনিয়ে আসবে এবং ক্বিয়ামত
সংঘটিত হবে।[7] মানুষের দেহগুলি সব মৃত্যুর পরে মাটিতে মিশে
যাবে। কিন্তু রূহগুলি স্ব স্ব ভাল বা মন্দ আমল অনুযায়ী ‘ইল্লীন’
অথবা ‘সিজ্জীনে’ অবস্থান করবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৭, ১৮) । যা
ক্বিয়ামতের পরপরই আল্লাহর হুকুমে স্ব স্ব দেহে পুনঃপ্রবেশ করবে
( ফজর ৮৯/২৯ ) এবং চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের জন্য সকল মানুষ সশরীরে
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে নীত হবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৪-৬) ।
মানুষের ঠিকানা হ’ল তিনটি : ১- দারুদ দুনিয়া। অর্থাৎ যেখানে
আমরা এখন বসবাস করছি ২- দারুল বরযখ। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে কবরের
জগত। ৩- দারুল ক্বারার। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন শেষ বিচার শেষে
জান্নাত বা জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা।
অতএব পৃথিবী হ’ল মানুষের জন্য সাময়িক পরীক্ষাগার মাত্র।
জান্নাত থেকে নেমে আসা মানুষ এই পরীক্ষাস্থলে পরীক্ষা শেষে
সুন্দর ফল লাভে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাবে, অথবা ব্যর্থকাম হয়ে
জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর সেখানেই হবে তাদের সর্বশেষ
যাত্রাবিরতি এবং সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা।
আল্লাহ বলেন, ‘মাটি থেকেই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি। ঐ
মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব। অতঃপর ঐ মাটি থেকেই আমরা
তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব’ (ত্বোয়াহা ২০/৫৫) । অতঃপর
বিচার শেষে কাফেরদেরকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে জাহান্নামের দিকে
এবং মুত্তাক্বীদের নেওয়া হবে জান্নাতে (যুমার ৩৯/৬৯-৭৩) ।
এভাবেই সেদিন যালেম তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে এবং মযলূম
তার যথাযথ প্রতিদান পেয়ে ধন্য হবে। সেদিন কারু প্রতি কোনরূপ
অবিচার করা হবে না (বাক্বারাহ ২/২৮১) ।
উল্লেখ্য যে, হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি
সূরায় ৫০টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[8]
এক্ষণে আদম সৃষ্টির ঘটনাবলী কুরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার
আলোকে সার-সংক্ষেপ আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
আদম সৃষ্টির কাহিনী :
আল্লাহ একদা ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে
‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে
তোমাদের বক্তব্য কি? তারা (সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে সৃষ্ট জিন জাতির
তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে) বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি
পৃথিবীতে এমন কাউকে আবাদ করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে
ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার
হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি।
এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য আপত্তির জন্য ছিল না, বরং
জানার জন্য ছিল। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা
জানো না (বাক্বারাহ ২/৩০) । অর্থাৎ আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন
একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন
এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-
সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত
করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।
খলীফা অর্থ :
এখানে ‘খলীফা’ বা প্রতিনিধি বলে জিনদের পরবর্তী প্রতিনিধি
হিসাবে বনু আদমকে বুঝানো হয়েছে, যারা পৃথিবীতে একে অপরের
প্রতিনিধি হবে (ইবনু কাছীর) । অথবা এর দ্বারা আদম ও পরবর্তী
ন্যায়নিষ্ঠ শাসকদের বুঝানো হয়েছে, যারা জনগণের মধ্যে আল্লাহর
আনুগত্য ও ইনছাফপূর্ণ শাসক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর
প্রতিনিধিত্ব করবে। কেননা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও অন্যায়
রক্তপাতকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতিনিধি নয় ( ইবনু জারীর )। তবে
প্রথম ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য, যা ফেরেশতাদের জবাবে প্রতীয়মান হয় যে,
এমন প্রতিনিধি আপনি সৃষ্টি করবেন, যারা পূর্ববর্তী জিন জাতির মত
পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ ও রক্তপাত ঘটাবে। বস্ত্ততঃ ‘জিন জাতির
উপর ক্বিয়াস করেই তারা এরূপ কথা বলে থাকতে পারে’ ( ইবনু
কাছীর )।
অতঃপর আল্লাহ আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। ‘সবকিছুর নাম’
বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে লয় পর্যন্ত ছোট-বড় সকল সৃষ্টবস্ত্তর
ইল্ম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দিয়ে দেওয়া হ’ল।[9] যা দিয়ে
সৃষ্টবস্ত্ত সমূহকে আদম ও বনু আদম নিজেদের অনুগত করতে পারে
এবং তা থেকে ফায়েদা হাছিল করতে পারে। যদিও আল্লাহর অসীম
জ্ঞানরাশির সাথে মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞানের তুলনা
মহাসাগরের অথৈ জলরাশির বুক থেকে পাখির ছোঁ মারা এক ফোঁটা
পানির সমতুল্য মাত্র।[10] বলা চলে যে, আদমকে দেওয়া সেই
যোগ্যতা ও জ্ঞান ভান্ডার যুগে যুগে তাঁর জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী
সন্তানদের মাধ্যমে বিতরিত হচ্ছে ও তার দ্বারা জগত সংসার উপকৃত
হচ্ছে। আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দেওয়ার পর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের
জন্য আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন। কুরআনে
কেবল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখিত হ’লেও সেখানে জিনদের সদস্য
ইবলীসও উপস্থিত ছিল (কাহফ ১৮/৫০) । অর্থাৎ আল্লাহ
চেয়েছিলেন, জিন ও ফেরেশতা উভয় সম্প্রদায়ের উপরে আদম-এর
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হৌক এবং বাস্তবে সেটাই হ’ল। তবে যেহেতু
ফেরেশতাগণ জিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, সেজন্য
কেবল তাদের নাম নেওয়া হয়েছে। আর দুনিয়াতে জিনদের
ইতিপূর্বেকার উৎপাত ও অনাচার সম্বন্ধে ফেরেশতারা আগে থেকেই
অবহিত ছিল, সেকারণ তারা মানুষ সম্বন্ধেও একইরূপ ধারণা পোষণ
করেছিল এবং প্রশ্নের জবাবে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছিল। উল্লেখ্য
যে, ‘আল্লাহ জিন জাতিকে আগেই সৃষ্টি করেন গনগনে আগুন থেকে’
(হিজর ১৫/২৭) । কিন্তু তারা অবাধ্যতার চূড়ান্ত করে।
আদমকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করার পর আল্লাহ
ফেরেশতাদেরকে ঐসব বস্ত্তর নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সঙ্গত
কারণেই তারা তা বলতে পারল না। তখন আল্লাহ আদমকে নির্দেশ
দিলেন এবং তিনি সবকিছুর নাম বলে দিলেন। ফলে ফেরেশতারা
অকপটে তাদের পরাজয় মেনে নিল এবং আল্লাহর মহত্ত্ব ও
পবিত্রতা ঘোষণা করে বলল, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যতটুকু
শিখিয়েছেন, তার বাইরে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি
সর্বজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিময়’ (বাক্বারাহ ২/৩২) । অতঃপর আল্লাহ তাদের
সবাইকে আদমের সম্মুখে সম্মানের সিজদা করতে বললেন। সবাই
সিজদা করল, ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল ও অহংকারে স্ফীত
হয়ে প্রত্যাখ্যান করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল
(বাক্বারাহ ২/৩৪) । ইবলীস ঐ সময় নিজের পক্ষে যুক্তি পেশ করে
বলল, ‘আমি ওর চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দ্বারা
সৃষ্টি করেছেন আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে’। আল্লাহ বললেন,
তুই বের হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত, তোর উপরে আমার অভিশাপ রইল
পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬-৭৮; আ‘রাফ ৭/১২) ।
সিজদার ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য :
আদমকে সৃষ্টি করার আগেই আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে আদমের প্রতি
সিজদা করার কথা বলে দিয়েছিলেন (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত
৪১/১১) । তাছাড়া কুরআনের বর্ণনা সমূহ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে,
আদমকে সিজদা করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ ব্যক্তি আদম হিসাবে
ছিল না, বরং ভবিষ্যৎ মানব জাতির প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে তাঁর
প্রতি সম্মান জানানোর জন্য জিন ও ফিরিশতাদের সিজদা করতে
বলা হয়েছিল। এই সিজদা কখনোই আদমের প্রতি ইবাদত পর্যায়ের
ছিল না। বরং তা ছিল মানবজাতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও
তাদেরকে সকল কাজে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দানের প্রতীকী ও
সম্মান সূচক সিজদা মাত্র।
ওদিকে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’লেও ইবলীস কিন্তু আল্লাহকে
সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে অস্বীকার করেনি। বরং আল্লাহ
যখন তাকে ‘অভিসম্পাৎ’ করে জান্নাত থেকে চিরদিনের মত
বিতাড়িত করলেন, তখন সে আল্লাহ্কে ‘রব’ হিসাবেই সম্বোধন করে
প্রার্থনা করল, ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺏِّ ﻓَﺄَﻧﻈِﺮْﻧِﻲ ﺇِﻟَﻰ ﻳَﻮْﻡِ ﻳُﺒْﻌَﺜُﻮﻥَ - ‘হে আমার প্রভু! আমাকে
আপনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিন’ (হিজর ১৫/৩৬, ছোয়াদ
৩৮/৭৯) । আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। অতঃপর সে বলল,
‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন,
আমিও তেমনি তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানারূপ সৌন্দর্যে প্রলুব্ধ
করব এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দেব। তবে যারা আপনার একনিষ্ঠ
বান্দা, তাদের ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৩৪-৪০; ছোয়াদ ৩৮/৭৯-৮৩) ।
আল্লাহ তাকে বললেন, তুমি নেমে যাও এবং এখান থেকে বেরিয়ে
যাও। তুমি নীচুতমদের অন্তর্ভুক্ত। এখানে তোমার অহংকার করার
অধিকার নেই’ (আ‘রাফ ৭/১৩) । উল্লেখ্য যে, ইবলীস জান্নাত থেকে
বহিষ্কৃত হ’লেও মানুষের রগ-রেশায় ঢুকে ধোঁকা দেওয়ার ও বিভ্রান্ত
করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন।[11] আর এটা ছিল মানুষের
পরীক্ষার জন্য। শয়তানের ধোঁকার বিরুদ্ধে জিততে পারলেই মানুষ
তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে এবং আখেরাতে
জান্নাত লাভে ধন্য হবে। নইলে ইহকাল ও পরকালে ব্যর্থকাম হবে।
মানুষের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদা করা ও ইবলীসের সিজদা না
করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে এ বিষয়ে যে, মানুষ যেন প্রতি পদে পদে
শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের
মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখে।
18
আদমের পাঁচটি শ্রেষ্ঠত্ব :
(১) আল্লাহ তাকে নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) । (২)
আল্লাহ নিজে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২) । (৩)
আল্লাহ তাকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিয়েছেন (বাক্বারাহ
২/৩১) । (৪) তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ
দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩৪) । (৫) আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট।
বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট (সাজদাহ ৩২/৭-৯) ।
ইবলীসের অভিশপ্ত হওয়ার কারণ ছিল তার ক্বিয়াস। সে আল্লাহর
আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করে বলেছিল, ‘আমি আদমের চাইতে
উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে
সৃষ্টি করেছেন মাটি দয়ে’ (হিজর ২৯) । মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন, ﺍﻭﻝ
ﻣﻦ ﻗﺎﺱ ﺍﺑﻠﻴﺲ ‘প্রথম ক্বিয়াস করেছিল ইবলীস’। হাসান বছরীও অনুরূপ
বলেছেন।[12]
নারী জাতি পুরুষেরই অংশ এবং তার অনুগত :
সিজদা অনুষ্ঠানের পর আল্লাহ আদমের জুড়ি হিসাবে তার অবয়ব
হ’তে একাংশ নিয়ে অর্থাৎ তার পাঁজর হ’তে তার স্ত্রী হাওয়াকে
সৃষ্টি করলেন[13] মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’
এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল
‘হাওয়া’ (কুরতুবী) । অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বললেন,
‘তোমরা দু’জন জান্নাতে বসবাস কর ও সেখান থেকে যা খুশী খেয়ে
বেড়াও। তবে সাবধান! এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা
সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৫) । এতে
বুঝা যায় যে, ফেরেশতাগণের সিজদা কেবল আদমের জন্য ছিল,
হাওয়ার জন্য নয়। দ্বিতীয়তঃ সিজদা অনুষ্ঠানের পরে আদমের অবয়ব
থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, পূর্বে নয়। তিনি পৃথক কোন সৃষ্টি
ছিলেন না। এতে পুরুষের প্রতি নারীর অনুগামী হওয়া প্রমাণিত হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪) ।
অতঃপর বহিষ্কৃত ইবলীস তার প্রথম টার্গেট হিসাবে আদম ও হাওয়ার
বিরুদ্ধে প্রতারণার জাল নিক্ষেপ করল। সেমতে সে প্রথমে তাদের খুব
আপনজন বনে গেল এবং নানা কথায় তাদের ভুলাতে লাগল। এক
পর্যায়ে সে বলল, ‘আল্লাহ যে তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে
নিষেধ করেছেন, তার কারণ হ’ল এই যে, তোমরা তাহ’লে ফেরেশতা
হয়ে যাবে কিংবা তোমরা এখানে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে’
(আ‘রাফ ৭/২০) । সে অতঃপর কসম খেয়ে বলল যে, আমি অবশ্যই
তোমাদের হিতাকাংখী’ (ঐ, ২১) । ‘এভাবেই সে আদম ও হাওয়াকে
সম্মত করে ফেলল এবং তার প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে তারা
উক্ত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করল। ফলে সাথে সাথে তাদের
গুপ্তাঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা তড়িঘড়ি গাছের পাতা সমূহ
দিয়ে তা ঢাকতে লাগল। আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি
তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান
তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (ঐ, ২২) তখন তারা অনুতপ্ত হ’য়ে বলল, ﻗَﺎﻻَ
ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻇَﻠَﻤْﻨَﺎ ﺃَﻧﻔُﺴَﻨَﺎ ﻭَﺇِﻥ ﻟَّﻢْ ﺗَﻐْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﻭَﺗَﺮْﺣَﻤْﻨَﺎ ﻟَﻨَﻜُﻮﻧَﻦَّ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺨَﺎﺳِﺮِﻳﻦَ - ‘হে আমাদের
পালনকর্তা! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যদি আপনি
আমাদের ক্ষমা না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের
অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (২৩) । ‘আল্লাহ তখন বললেন, তোমরা (জান্নাত
থেকে) নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের অবস্থান
হবে পৃথিবীতে এবং সেখানেই তোমরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত
সম্পদরাজি ভোগ করবে’ (২৪) । তিনি আরও বললেন যে, ‘তোমরা
পৃথিবীতেই জীবনযাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান
থেকেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/২০-২৫) ।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইবলীসের কথায়
সর্বপ্রথম হাওয়া প্রতারিত হন। অতঃপর তার মাধ্যমে আদম প্রতারিত
হন বলে যে কথা চালু আছে কুরআনে এর কোন সমর্থন নেই। ছহীহ
হাদীছেও স্পষ্ট কিছু নেই। এ বিষয়ে তাফসীরে ইবনু জারীরে ইবনু
আববাস (রাঃ) থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ।[14] দ্বিতীয়তঃ
জান্নাত থেকে অবতরণের নির্দেশ তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ
ছিলনা। কেননা এটা ছিল তওবা কবুলের পরের ঘটনা। অতএব এটা ছিল
হয়তবা তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দানের জন্য। বরং সঠিক কথা এই যে,
এটা ছিল আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ।
কেননা জান্নাত হ’ল কর্মফল লাভের স্থান, কর্মের স্থান নয়।
তাছাড়া জান্নাতে মানুষের বংশ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। এজন্য দুনিয়ায়
নামিয়ে দেওয়া যরূরী ছিল।
প্রথম বার আদেশ দানের পরে পুনরায় স্নেহ ও অনুগ্রহ মিশ্রিত আদেশ
দিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই নেমে যাও’। অতঃপর পৃথিবীতে
আল্লাহর খলীফা হওয়ার (বাক্বারাহ ২/৩০; ফাত্বির ৩৫/৩৯) মহান
মর্যাদা প্রদান করে বললেন, ‘তোমাদের নিকটে আমার পক্ষ থেকে
হেদায়াত অবতীর্ণ হবে। যারা তার অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন
ভয় বা চিন্তার কারণ থাকবে না। কিন্তু যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে
ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং
সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ
২/৩৮-৩৯) ।
উল্লেখ্য যে, নবীগণ ছিলেন নিষ্পাপ এবং হযরত আদম (আঃ) ছিলেন
নিঃসন্দেহে নিষ্পাপ। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল করেননি। বরং
শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত হয়ে তিনি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ
বৃক্ষের নিকটবর্তী হওয়ার নিষেধাজ্ঞার কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন।
যেমন অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ﻓَﻨَﺴِﻲَ ﻭَﻟَﻢْ ﻧَﺠِﺪْ ﻟَﻪُ ﻋَﺰْﻣًﺎ - ‘অতঃপর
আদম ভুলে গেল এবং আমি তার মধ্যে (সংকল্পের) দৃঢ়তা পাইনি’
(ত্বোয়াহা ২০/১১৫) । তাছাড়া উক্ত ঘটনার সময় তিনি নবী হননি বরং
পদস্খলনের ঘটনার পরে আল্লাহ তাকে নবী মনোনীত করে দুনিয়ায়
পাঠান ও হেদায়াত প্রদান করেন’ (আ‘রাফ ৭/১২২) ।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইবলীসের ক্ষেত্রে আল্লাহ বললেন,
ﻗَﺎﻝَ ﻓَﺎﺧْﺮُﺝْ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﻓَﺈِﻧَّﻚَ ﺭَﺟِﻴﻢٌ - ‘তুমি জান্নাত থেকে বেরিয়ে যাও। নিশ্চয়ই
তুমি অভিশপ্ত’ (হিজর ১৫/৩৪; আ‘রাফ ৭/১৮) । অন্যদিকে আদম ও
হাওয়ার ক্ষেত্রে বললেন, ﻗُﻠْﻨَﺎ ﺍﻫْﺒِﻄُﻮﺍْ ﻣِﻨْﻬَﺎ - ‘ তোমরা নেমে যাও’
(বাক্বারাহ ২/৩৬, ৩৮; আ‘রাফ ৭/২৪) । এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে,
ইবলীস কখনোই আর জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু বনু
আদমের ঈমানদারগণ পুনরায় ফিরে আসতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
নগ্নতা শয়তানের প্রথম কাজ :
মানুষের উপরে শয়তানের প্রথম হামলা ছিল তার দেহ থেকে কাপড়
খসিয়ে তাকে উলঙ্গ করে দেওয়া। আজও পৃথিবীতে শয়তানের পদাংক
অনুসারী ও ইবলীসের শিখন্ডীদের প্রথম কাজ হ’ল তথাকথিত
ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার নামে নারীকে উলঙ্গ করে ঘরের বাইরে
আনা ও তার সৌন্দর্য উপভোগ করা। অথচ পৃথিবীর বিগত সভ্যতাগুলি
ধ্বংস হয়েছে মূলতঃ নারী ও মদের সহজলভ্যতার কারণেই। অতএব
সভ্য-ভদ্র ও আল্লাহভীরু বান্দাদের নিকটে ঈমানের পর সর্বপ্রথম
ফরয হ’ল স্ব স্ব লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও ইযযত-আবরূর হেফাযত
করা। অন্যান্য ফরয সবই এর পরে। নারীর পর্দা কেবল পোষাকে হবে
না, বরং তা হবে তার ভিতরে, তার কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে ও
চাল-চলনে সর্ব বিষয়ে। পরনারীর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও মিষ্ট
কণ্ঠস্বর পরপুরুষের হৃদয়ে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে। অতএব
লজ্জাশীলতাই মুমিন নর-নারীর অঙ্গভূষণ ও পারস্পরিক নিরাপত্তার
গ্যারান্টি। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে একে অপরের থেকে স্ব স্ব
দৃষ্টিকে অবনত রাখবে (নূর ২৪/৩০-৩১) এবং পরস্পরে সার্বিক পর্দা
বজায় রেখে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটুকু স্বাভাবিকভাবে
সংক্ষেপে বলবে। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও
পর্দা বজায় রেখে স্ব স্ব কর্মস্থলে ও কর্মপরিধির মধ্যে
স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং সংসার ও সমাজের কল্যাণে সাধ্যমত
অবদান রাখবে। নেগেটিভ ও পজেটিভ পাশাপাশি বিদ্যুৎবাহী দু’টি
ক্যাবলের মাঝে প্লাষ্টিকের আবরণ যেমন পর্দার কাজ করে এবং
অপরিহার্য এক্সিডেন্ট ও অগ্নিকান্ড থেকে রক্ষা করে, অনুরূপভাবে
পরনারী ও পরপুরুষের মধ্যকার পর্দা উভয়ের মাঝে ঘটিতব্য যেকোন
অনাকাংখিত বিষয় থেকে পরস্পরকে হেফাযত করে। অতএব শয়তানের
প্ররোচনায় জান্নাতের পবিত্র পরিবেশে আদি পিতা-মাতার জীবনে
ঘটিত উক্ত অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা থেকে দুনিয়ার এই পঙ্কিল পরিবেশে
বসবাসরত মানব জাতিকে আরও বেশী সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত।
কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে সেদিকেই হুঁশিয়ার করেছে।
মানব সৃষ্টির রহস্য :
আল্লাহ বলেন, ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻟِﻠْﻤَﻼَﺋِﻜَﺔِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺧَﺎﻟِﻖٌ ﺑَﺸَﺮًﺍ ﻣِّﻦ ﺻَﻠْﺼَﺎﻝٍ ﻣِّﻦْ ﺣَﻤَﺈٍ ﻣَّﺴْﻨُﻮْﻥٍ،
ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺳَﻮَّﻳْﺘُﻪُ ﻭَﻧَﻔَﺨْﺖُ ﻓِﻴْﻪِ ﻣِﻦ ﺭُّﻭﺣِﻲْ ﻓَﻘَﻌُﻮْﺍ ﻟَﻪُ ﺳَﺎﺟِﺪِﻳْﻦَ - ‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা,
যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার
শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব
পূর্ণভাবে তৈরী করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন
তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে’ (হিজর ১৫/২৮-২৯) । অন্যত্র
তিনি বলেন, ﻫُﻮَ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻳُﺼَﻮِّﺭُﻛُﻢْ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺣَﺎﻡِ ﻛَﻴْﻒَ ﻳَﺸَﺂﺀُ ﻵ ﺇِﻟَﻪَ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺍﻟْﻌَﺰِﻳﺰُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴﻢُ-
( ﺁﻝ ﻋﻤﺮﺍﻥ ৬)- ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে
আকার-আকৃতি দান করেছেন যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ব্যতীত
কোন উপাস্য নেই। তিনি মহা পরাক্রান্ত ও মহা বিজ্ঞানী’ (আলে
ইমরান ৩/৬) । তিনি আরও বলেন, ﻳَﺨْﻠُﻘُﻜُﻢْ ﻓِﻲْ ﺑُﻄُﻮْﻥِ ﺃُﻣَّﻬَﺎﺗِﻜُﻢْ ﺧَﻠْﻘًﺎ ﻣِّﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﺧَﻠْﻖٍ
ﻓِﻲ ﻇُﻠُﻤَﺎﺕٍ ﺛَﻼَﺙٍ- ( ﺯﻣﺮ ৬)- ‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে
সৃষ্টি করেন একের পর এক স্তরে তিনটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণের
মধ্যে’ (যুমার ৩৯/৬) । তিনটি আবরণ হ’ল- পেট, রেহেম বা জরায়ু এবং
জরায়ুর ফুল বা গর্ভাধার।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে আদম সৃষ্টির তিনটি পর্যায় বর্ণনা করা
হয়েছে। প্রথমে মাটি দ্বারা অবয়ব নির্মাণ, অতঃপর তার আকার-
আকৃতি গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহে শক্তির আনুপতিক হার নির্ধারণ
ও পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং সবশেষে তাতে রূহ
সঞ্চার করে আদমকে অস্তিত্ব দান। অতঃপর আদমের অবয়ব (পাঁজর)
থেকে কিছু অংশ নিয়ে তার জোড়া বা স্ত্রী সৃষ্টি করা। সৃষ্টির সূচনা
পর্বের এই কাজগুলি আল্লাহ সরাসরি নিজ হাতে করেছেন (ছোয়াদ
৩৮/৭৫) । অতঃপর এই পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করে
প্রথম যে যমজ সন্তান জন্ম দেয়, তারাই হ’ল মানুষের মাধ্যমে সৃষ্ট
পৃথিবীর প্রথম মানব যুগল। তারপর থেকে এযাবত স্বামী-স্ত্রীর
মিলনে মানুষের বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদরাজি, জীবজন্তু ও প্রাণীকুলের সৃষ্টি হয়েছে
মাটি থেকে। আর মাটি সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে। পানিই হ’ল সকল
জীবন্ত বস্ত্তর মূল (ফুরক্বান ২৫/৫৪) ।
মৃত্তিকাজাত সকল প্রাণীর জীবনের প্রথম ও মূল একক (Unit) হচ্ছে
‘প্রোটোপ্লাজম’ (Protoplasm)। যাকে বলা হয় ‘আদি প্রাণসত্তা’। এ
থেকেই সকল প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী
একে Bomb shell বলে অভিহিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাটির
সকল প্রকারের রাসায়নিক উপাদান। মানুষের জীবন বীজে প্রচুর
পরিমাণে চারটি উপাদান পাওয়া যায়। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন,
কার্বন ও হাইড্রোজেন। আর আটটি পাওয়া যায় সাধারণভাবে
সমপরিমাণে। সেগুলি হ’ল- ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম,
ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, সালফার ও আয়রণ। আরও আটটি
পদার্থ পাওয়া যায় স্বল্প পরিমাণে। তাহ’ল: সিলিকন, মোলিবডেনাম,
ফ্লুরাইন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার ও যিংক। কিন্তু
এই সব উপাদান সংমিশ্রিত করে জীবনের কণা তথা ‘প্রোটোপ্লাজম’
তৈরী করা সম্ভব নয়। জনৈক বিজ্ঞানী দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এসব মৌল
উপাদান সংমিশ্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন
এবং তাতে কোন জীবনের ‘কণা’ পরিলক্ষিত হয়নি। এই সংমিশ্রণ ও
তাতে জীবন সঞ্চার আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান
এক্ষেত্রে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে সরাসরি আদমকে অতঃপর আদম থেকে
তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ আদম
সন্তানদের মাধ্যমে বনু আদমের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন।
এখানেও রয়েছে সাতটি স্তর। যেমন: মৃত্তিকার সারাংশ তথা
প্রোটোপ্লাজম, বীর্য বা শুক্রকীট, জমাট রক্ত, মাংসপিন্ড,
অস্থিমজ্জা, অস্থি পরিবেষ্টনকারী মাংস এবং সবশেষে রূহ সঞ্চারণ
(মুমিনূন ২৩/১২-১৪; মুমিন ৪০/৬৭; ফুরক্বান ২৫/৪৪; তারেক্ব
৮৬/৫-৭) । স্বামীর শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে রক্ষিত ডিম্বকোষে
প্রবেশ করার পর উভয়ের সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে
(দাহর ৭৬/২) । উল্লেখ্য যে, পুরুষের একবার নির্গত লম্ফমান বীর্যে
লক্ষ-কোটি শুক্রাণু থাকে। আল্লাহর হুকুমে তন্মধ্যকার একটি মাত্র
শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবেশ করে। এই শুক্রকীট পুরুষ ক্রোমোজম Y
অথবা স্ত্রী ক্রোমোজম X হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেটি স্ত্রীর
ডিম্বের X ক্রোমোজমের সাথে মিলিত হয়, সেভাবেই পুত্র বা কন্যা
সন্তান জন্ম গ্রহণ করে আল্লাহর হুকুমে।
মাতৃগর্ভের তিন তিনটি গাঢ় অন্ধকার পর্দার অন্তরালে এইভাবে
দীর্ঘ নয় মাস ধরে বেড়ে ওঠা প্রথমত: একটি পূর্ণ জীবন সত্তার সৃষ্টি,
অতঃপর একটি জীবন্ত প্রাণবন্ত ও প্রতিভাবান শিশু হিসাবে
দুনিয়াতে ভূমিষ্ট হওয়া কতই না বিষ্ময়কর ব্যাপার। কোন মানুষের
পক্ষে এই অনন্য-অকল্পনীয় সৃষ্টিকর্ম আদৌ সম্ভব কী? মাতৃগর্ভের ঐ
অন্ধকার গৃহে মানবশিশু সৃষ্টির সেই মহান কারিগর কে? কে সেই মহান
আর্কিটেক্ট, যিনি ঐ গোপন কুঠরীতে পিতার ২৩টি ক্রোমোজম ও
মাতার ২৩টি ক্রোমোজম একত্রিত করে সংমিশ্রিত বীর্য প্রস্ত্তত
করেন? কে সেই মহান শিল্পী, যিনি রক্তপিন্ড আকারের জীবন
টুকরাটিকে মাতৃগর্ভে পুষ্ট করেন? অতঃপর ১২০ দিন পরে তাতে রূহ
সঞ্চার করে তাকে জীবন্ত মানব শিশুতে পরিণত করেন এবং পূর্ণ-
পরিণত হওয়ার পরে সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেন ( আবাসা
৮০/১৮-২০ )। বাপ-মায়ের স্বপ্নের ফসল হিসাবে নয়নের পুত্তলি
হিসাবে? মায়ের গর্ভে মানুষ তৈরীর সেই বিষ্ময়কর যন্ত্রের দক্ষ
কারিগর ও সেই মহান শিল্পী আর কেউ নন, তিনি আল্লাহ!
সুবহানাল্লাহি ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযীম!!
পুরুষ ও নারীর সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম লাভের তথ্য কুরআনই
সর্বপ্রথম উপস্থাপন করেছে ( দাহর ৭৬/২ )। আধুনিক বিজ্ঞান এ তথ্য
জনতে পেরেছে মাত্র গত শতাব্দীতে ১৮৭৫ সালে ও ১৯১২ সালে।
তার পূর্বে এরিষ্টটল সহ সকল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল যে, পুরুষের
বীর্যের কোন কার্যকারিতা নেই। রাসূলের হাদীছ বিজ্ঞানীদের এই
মতকে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেছে।[15] কেননা সেখানে স্পষ্টভাবে
বলা হয়েছে সন্তান প্রজননে পুরুষ ও নারী উভয়ের বীর্য সমানভাবে
কার্যকর।
উল্লেখ্য যে, মাতৃগর্ভে বীর্য প্রথম ৬ দিন কেবল বুদ্বুদ আকারে
থাকে। তারপর জরায়ুতে সম্পর্কিত হয়। তিন মাসের আগে ছেলে বা
মেয়ে সন্তান চিহ্নিত হয় না। চার মাস পর রূহ সঞ্চারিত হয়ে বাচ্চা
নড়েচড়ে ওঠে ও আঙ্গুল চুষতে থাকে। যাতে ভূমিষ্ট হওয়ার পরে
মায়ের স্তন চুষতে অসুবিধা না হয়। এ সময় তার কপালে চারটি বস্ত্ত
লিখে দেওয়া হয়। তার আজাল (হায়াত), আমল, রিযিক এবং সে
ভাগ্যবান না দুর্ভাগা।[16]
এভাবেই জগত সংসারে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা এগিয়ে চলেছে। এ
নিয়মের ব্যতিক্রম নেই কেবল আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। একারণেই
আল্লাহ অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মানুষ কি দেখে না
যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে
গেল প্রকাশ্যে বিতন্ডাকারী’। ‘সে আমাদের সম্পর্কে নানারূপ
দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়, আর
বলে যে, কে জীবিত করবে এসব হাড়গোড় সমূহকে, যখন সেগুলো পচে
গলে যাবে? (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৮) ।
জান্নাত থেকে পতিত হবার পর :
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে ইমাম
আহমাদ, নাসাঈ ও হাকেম (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, ﺃﻟﺴﺖ ﺑﺮﺑﻜﻢ ‘আমি
কি তোমাদের প্রভু নই? বনু আদমের কাছ থেকে এই বহুল প্রসিদ্ধ
‘আহদে আলাস্ত্ত’ বা প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতিটি তখনই নেওয়া হয়,
যখন আদম (আঃ)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়।
আর এ প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল না‘মান ( ﻭﺍﺩﻯ ﻧَﻌْﻤَﺎﻥَ ) নামক
উপত্যকায়, যা পরবর্তীকালে ‘আরাফাত’-এর ময়দান নামে পরিচিত
হয়েছে।[17] এর দ্বারা একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, জান্নাত ও
জাহান্নামের অবস্থান পৃথিবীর বাইরে অন্যত্র এবং তা সৃষ্ট অবস্থায়
তখনও ছিল এখনও আছে। আধুনিক বিজ্ঞান এ পৃথিবী ও সৌরলোকের
বাইরে দূরে বহুদূরে অগণিত সৌরলোকের সন্ধান দিয়ে কুরআন ও
হাদীছের তথ্যকেই সপ্রমাণ করে দিচ্ছে।
আদমের অবতরণ স্থল :
আদম ও হাওয়াকে আসমানে অবস্থিত জান্নাত থেকে নামিয়ে
দুনিয়ায় কোথায় রাখা হয়েছিল, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন বলা
হয়েছে আদমকে সরনদীপে (শ্রীলংকা) ও হাওয়াকে জেদ্দায় (সঊদী
আরব) এবং ইবলীসকে বছরায় (ইরাক) ও ইবলাসের জান্নাতে ঢোকার
কথিত বাহন সাপকে ইস্ফাহানে (ইরান) নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কেউ বলেছেন, আদমকে মক্কার ছাফা পাহাড়ে এবং হাওয়াকে
মারওয়া পাহাড়ে নামানো হয়েছিল। এছাড়া আরও বক্তব্য এসেছে।
তবে যেহেতু কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি,
সেকারণ এ বিষয়ে আমাদের চুপ থাকাই শ্রেয়।
‘আহ্দে আলাস্ত্ত-র বিবরণ :
মুসলিম ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, কিছু লোক হযরত ওমর ফারূক
(রাঃ)-এর নিকটে সূরা আ‘রাফ ১৭২ আয়াতের মর্ম জানতে চাইলে
তিনি বলেন,
No comments