নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী, ( لا عدوى ولاطيرة ولا هامة ولا صفر ) “একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়না। পাখী উড়িয়ে বা পাখীর ডাক শুনে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণের নিয়ম ইসলামে নেই।
রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
গ্রন্থঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম | রচনা/অনুবাদ/সংকলনঃ শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) |
সম্মানিত শায়খ! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী, ( لا عدوى ولاطيرة ولا هامة ولا صفر ) “একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়না। পাখী উড়িয়ে বা পাখীর ডাক শুনে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণের নিয়ম ইসলামে নেই। সফর মাসকেও অশুভ মনে করাও ঠিক নয়। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চাই। হাদীছে বর্ণিত জিনিষগুলোর প্রভাবকে অস্বীকার করা হয়েছে। এগুলো কোন ধরণের অস্বীকার? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর বাণী, “কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন কর যেভাবে তুমি বাঘ থেকে ভয়ে পলায়ন কর”। এই হাদীছ ও প্রথমোক্ত হাদীছের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করব? |
একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হওয়াকে আদ্ওয়া বলা হয়। শারীরিক রোগে যেমন এটা হয়, তেমনি চারিত্রিক রোগের ক্ষেত্রেও এমন হয়ে থাকে। এ জন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, অসৎ বন্ধু কামারের ন্যায়। সে হয়ত তোমার জামা পুড়িয়ে ফেলবে। তা না হলে কমপক্ষে তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে। কোন জিনিষ দেখে, কোন কথা শুনে বা জানার মাধ্যমে কুলক্ষণ মনে করাকে ‘ত্বিয়ারা’ বলা হয়। ‘হামাহ’ এর ব্যাখ্যা দু’ধরণ হতে পারে। ক) এমন রোগ, যা একজনকে আক্রমণ করে অন্যজনের নিকট সংক্রমিত হয়। খ) ‘হামাহ’ বলা হয়, আরবদের ধারণামতে এমন এক শ্রেণীর পাখিকে, যে গভীর রাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার পরিবারের লোকদেরকে ডাকাডাকি করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার উৎসাহ দেয়। কেউ কেউ ধারণা করে যে, এটি নিহত ব্যক্তির রূহ পাখির আকৃতি ধরে উপস্থিত হয়েছে। এই পাখিটিকে আমাদের পরিভাষায় হুতুম পেঁচা বলা হয়। তৎকালিন আরবরা এ পাখির ডাককে কুলক্ষণ মনে করত। কারো ঘরের পাশে এসে এ পাখি ডাকলে তারা বিশ্বাস করত যে, সে মৃত্যু বরণ করবে। ‘ছফর’ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (১) আরবী ছফর মাস। আরবরা এ মাসকে অকল্যাণের মাস মনে করত। (২) এটি উটের এক ধরণের রোগের নাম, যা এক উটের শরীর থেকে অন্য উটের শরীরে সংক্রমিত হয়। (৩) ছফর মাসকে আরবরা কখনো হারাম মাসের সাথে গণনা করত। আবার কখনো হালাল মাস হিসাবে গণ্য করত। এটি আরবদের গোমরাহী মূলক একটি আচরণ। তবে উল্লেখিত ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে গ্রহণযোগ্য কথা হল, জাহেলী সমাজের লোকেরা ছফর মাসকে অমঙ্গলের মাস মনে করত। মূলতঃ কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণে সময় বা মাসের কোন প্রভাব নেই। ছফর মাস অন্যান্য মাসের মতই। তাতে কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর নির্ধারণ অনুযায়ীই হয়ে থাকে। উপরে বর্ণিত ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করতে গিয়ে কোন কোন মানুষ যখন ছফর মাসে কোন কাজ সমাধা করে, তখন সেই তারিখ লিখে রাখে এবং বলে কল্যাণের মাস ছফর মাসের অমুক তারিখে কাজটি সমাধা হল। এটি এক বিদ্আত দ্বারা অন্য বিদ্আতের এবং এক অজ্ঞতা দ্বারা অন্য অজ্ঞতার চিকিৎসা করার শামিল। এটি কল্যাণের মাসও নয় এবং অকল্যাণের মাসও নয়। এই জন্যই কোন কোন বিদ্বান পেঁচার ডাক শুনে (خيرا ان شاء الله) “আল্লাহ চাহেতো ভাল হবে” এ কথা বলার প্রতিবাদ করেছেন। ভাল বা খারাপ কোন কিছুই বলা যাবে না। সে অন্যান্য পাখির মতই ডাকে। উপরের চারটি বিষয়ের প্রভাবকে হাদীছে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় আল্লাহর উপর ভরসা করা সকল মু’মিনের উপর আবশ্যক। এতে ঈমান মজবুত হবে। এ সমস্ত কুসংস্কারের সামনে মুমিন ব্যক্তি কখনো দুর্বল হবে না। কোন মুসলিম ব্যক্তি যখন এ সমস্ত বিষয়ের প্রভাবকে বিশ্বাস করবে, তখন নিম্নলিখিত দু’অবস্থার এক অবস্থা হতে পারেঃ (১) সে হয়ত বিশ্বাস করে সামনের দিকে অগ্রসর হবে অথবা থেমে যাবে। এ অবস্থায় তার কর্মসমূহ এমন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করল, যার কোন প্রভাব নেই। (২) কোন কিছু পরওয়া না করে কাজের প্রতি অগ্রসর হবে, কিন্তু মনের ভিতরে দুর্বলতা ও দুশ্চিন্তা থেকেই যাবে। কিন্তু এটি প্রথমটির চেয়ে হালকা। কারণ সে এ সমস্ত বিষয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকে। কিছু কিছু মানুষ শুভ-অশুভ নির্ধারণ করার জন্য কুরআন মাজীদ খুলে থাকে। খুলে জাহান্নামের আলোচনা দেখতে পেলে লক্ষণ ভাল নয় বলে মনে করে। আর জান্নাতের আলোচনা দেখতে পেলে খুশী হয়। এটি জাহেলী যামানার লোকদের কাজের মতই। যারা জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উক্ত জিনিষগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি। কারণ এগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এগুলোর প্রভাবকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেনে নেন নি। আল্লাহই সকল বস্তর উপর প্রভাব বিস্তারকারী। সুতরাং যদি জানা যায় যে, কোন বস্ত সংঘটিত হওয়াতে সঠিক কারণ রয়েছে, তাহলে তাকে কারণ হিসাবে বিশ্বাস করা বৈধ। কিন্তু নিছক ধারণা করে কোন ঘটনায় অন্য বস্তর প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কোন বস্ত নিজে নিজেই অন্য ঘটনার কারণ হতে পারে না। সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “অসুস্থ উটের মালিক যেন সুস্থ উটের মালিকের উটের কাছে অসুস্থ উটগুলো নিয়ে না যায়।” সুস্থ উটগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ রকম বলেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেনঃ فِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنَ الْأَسَدِ সিংহের ভয়ে তুমি যেমন পলায়ন কর, জুযাম (কুষ্ঠ) রোগী দেখেও তুমি সেভাবে পলায়ন কর। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। এখানে রোগের চলমান শক্তির কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে রোগ নিজস্ব ক্ষমতা বলে অন্যজনের কাছে চলে যায় তা অনিবার্য নয়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেনঃ )وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ( “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা। (সূরা বাক্বারাঃ ১৯৫) এটা বলা যাবে না যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোগের সংক্রমন হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। কেননা বাস্তব অবস্থা ও অন্যান্য হাদীছের মাধ্যমে এ রকম ধারণাকে খন্ডন করা হয়েছে। যদি বলা হয় যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বললেন, রোগ সংক্রামিত হয়না, তখন একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! মরুভূমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ উট বিচরণ করে। উটগুলোর কাছে যখন একটি খুজ্লিযুক্ত উট আসে, তখন সব উটই খুজ্লিযুক্ত হয়ে যায়। তিনি বললেন, প্রথম উটটিকে কে খুজ্লিযুক্ত করল? উত্তর হল, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উক্তি “প্রথমটিকে কে খুজ্লিযুক্ত করল?” এর মাধ্যমেই জবাব দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগের জীবানু অসুস্থ ব্যক্তির নিকট থেকে সুস্থ ব্যক্তির নিকট গমণ করে থাকে। তাই আমরা বলব যে, প্রথম উটের উপরে সংক্রামক ব্যতীত আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগ নাযিল হয়েছে। কোন ঘটনার পিছনে কখনো প্রকাশ্য কারণ থাকে। আবার কখনো প্রকাশ্য কোন করণ থাকে না। প্রথম উট খুজ্লিযুক্ত হওয়ার পিছনে আল্লাহর নির্ধারণ ব্যতীত অন্য কোন কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় উট খুজ্লিযুক্ত হওয়ার কারণ যদিও জানা যাচ্ছে, তথাপি আল্লাহ চাইলে খুজ্লিযুক্ত হত না। তাই কখনো খুজলিতে আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তীতে ভালও হয়ে যায়। আবার কখনো মারাও যায়। এমনিভাবে প্লেগ, কলেরা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেও একই কথা। একই ঘরের কয়েকজন আক্রান্ত হয়। কেউ মারা যায় আবার কেউ রেহাই পেয়ে যায়। মানুষের উচিৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা। বর্ণিত আছে যে, ‘একজন কুষ্ঠ রোগী লোক নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কাছে আসল। তিনি তার হাত ধরে বললেন, আমার সাথে খাও।’ আল্লাহর উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা থকার কারণেই তিনি তাকে খানায় শরীক করেছিলেন। উপরের বিরোধপূর্ণ হাদীছগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য বিধানে যা বলা হল, তাই সর্বোৎকৃষ্ট। কেউ কেউ প্রশ্নের শেষোক্ত হাদীছকে মানসুখ বা রহিত বলেছেন। রহিত হওয়ার দাবী ঠিক নয়। কেননা রহিত হওয়ার অন্যতম শর্ত হল বিরোধপূর্ণ হাদীছের মধ্যে সমঝোতা করা সম্ভব না হওয়া। উভয় হাদীছের মধ্যে মিল দেয়া সম্ভব হলে উভয় হাদীছের উপর আমল করতে হবে। আর রহিত হওয়ার দাবী করলে এক পক্ষের হাদীছের উপর আমল বাতিল হয়ে যায়। এক পক্ষের হাদীছগুলো বাতিল করার চেয়ে উভয় পক্ষের হাদীছগুলোর উপর আমল করাই উত্তম। |
No comments